মানুষ সভ্যতার চূড়ায় পৌঁছেছে, বিজ্ঞানের আলোয় ভর করেছে পৃথিবী। কিন্তু কিছু কিছু ঘটনা এমন যে, সেগুলো যেন সভ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তেমনি একটি ঘটনা ঘটে ১৯১৬ সালে, যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যে। যেখানে একটি নিরীহ হাতিকে মানুষের আদেশে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়। এই হৃদয়বিদারক ঘটনা আজও বিশ্বজুড়ে অনেকের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ ঘটায়।

হাতিটির নাম ছিল মেরি

মেরি ছিল একটি এশিয়ান হাতি। সে ছিল “স্পার্কস ব্রাদার্স সার্কাস” নামক একটি ভ্রাম্যমাণ সার্কাস দলের প্রধান আকর্ষণ। বিশাল দেহের এই হাতিটি ছিল অত্যন্ত প্রশিক্ষিত ও দর্শকের প্রিয়। দশ বছর ধরে সে সার্কাসে নানা কসরত দেখিয়ে মানুষকে আনন্দ দিয়ে আসছিল।

সেই ভয়ানক দিন

১৯১৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর, সার্কাসটি এসে পৌঁছায় টেনেসির এক ছোট শহর, এরউইন-এ। সার্কাস শুরুর আগে হাতিগুলোকে রাস্তার মধ্য দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, যাতে লোকজন আগ্রহী হয়। তখনই ঘটে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।

হাতিগুলোর দায়িত্বে ছিল একজন নতুন “হ্যান্ডলার”—রেড এলড্রিজ নামের এক ব্যক্তি। সে ছিল মূলত হোটেল কর্মচারী, যাকে হাতির দেখভালের প্রশিক্ষণ ছাড়াই নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

রেড এলড্রিজ মেরিকে একটি লোহার হুক দিয়ে চালাতে চাইছিল। কিছুক্ষণ পর মেরি আচরণগতভাবে অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে। হয়তো হুকের আঘাত তাকে রাগিয়ে দিয়েছিল, অথবা সে ভয় পেয়েছিল। হঠাৎ করেই সে এলড্রিজকে শুঁড় দিয়ে তুলে মাটিতে আছাড় দেয় এবং পা দিয়ে চেপে মেরে ফেলে।

প্রতিক্রিয়া: বিচার না করেই মৃত্যুদণ্ড

এই ঘটনাটি মুহূর্তেই শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ক্রুদ্ধ জনতা হাতিটির বিচার দাবি করে। কেউ কেউ বলে, মেরি এখন “খুনী হাতি”—তাকে বাঁচিয়ে রাখা মানে আরও বিপদ ডেকে আনা। ফলে সার্কাস কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়, হাতিটিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হবে—যেন এটা এক ধরনের “আইনি বিচার”।

ফাঁসির দিন: ইতিহাসের নির্মমতম দৃশ্য

১২ সেপ্টেম্বর, ১৯১৬। শহরের রেলইয়ার্ডে তৈরি করা হয় অস্থায়ী ফাঁসির মঞ্চ। সেখানে শত শত মানুষ—পুরুষ, নারী, এমনকি শিশুরাও ভিড় জমায়। একটি বিশাল ক্রেন ব্যবহার করে মেরিকে শিকল দিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।

প্রথমবার যখন তাকে ঝোলানো হয়, শিকল ছিঁড়ে যায়। মেরি মাটিতে পড়ে যায় এবং প্রচণ্ড যন্ত্রণায় কাতরায়। পরে আবার শিকল জোড়া দিয়ে দ্বিতীয়বার ফাঁসিতে তোলা হয়। এইবার সফল হয় ‘ফাঁসি’। প্রায় ১০ মিনিট ধরে মেরি শূন্যে ঝুলে থাকে—নিঃসাড়, নিশ্চল।

প্রশ্নবিদ্ধ মানবতা

একটি প্রাণী—যার কোনো আইনগত অধিকার ছিল না, যে আত্মরক্ষায় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল, তাকে কোন যুক্তিতে মানুষ “বিচার” করে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে? শুধুমাত্র মানুষের বিনোদনের জন্য সার্কাসে বন্দী করে রাখা, প্রশিক্ষণ দিতে গিয়ে তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা—এসবের বিচার কে করল?

আজকের সভ্য সমাজে দাঁড়িয়ে এই ঘটনার দিকে তাকালে চোখে জল এসে যায়। মেরি ছিল না কোনো অপরাধী। সে ছিল এক নিষ্পাপ প্রাণী, যে মানুষের নিষ্ঠুরতার শিকার হয়েছিল।

উপসংহার

মেরির কাহিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—ক্ষমতা যখন অন্ধ হয়ে যায়, তখন তা করুণা, বিবেক ও ন্যায়ের সব সীমা অতিক্রম করে। একটি প্রাণী, যে শুধু ভালোবাসা আর যত্ন পেলে সারাজীবন বিশ্বস্ত থেকে যেতে পারত, তাকেই মানুষ হত্যা করেছে বর্বরতার চূড়ান্ত উদাহরণ হিসেবে।

মেরির মৃত্যুর গল্প শুধুই ইতিহাস নয়, এটি মানবতার আয়নায় একটি কলঙ্কের ছাপ।

Cute Bangla 24

View all posts

Add comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Cute Bangla 24

Latest videos