সাধারণত আমরা ভাবি, ব্যাংকের নিরাপত্তা মানেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, পাহারাদার এবং অজেয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা। কিন্তু ২০১৬ সালে এমন একটি ঘটনা ঘটে যায়, যা বিশ্বব্যাপী সবাইকে হতবাক করে দেয়। হ্যাঁ, কথা বলছি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক—বাংলাদেশ ব্যাংক হ্যাকিং কেলেঙ্কারি নিয়ে। এটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম বড় সাইবার চুরি। চলুন জেনে নিই, কীভাবে এই অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটেছিল।
শুরুটা হয় একটি “ফিশিং ইমেইল” দিয়ে
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি কম্পিউটার সিস্টেমে অনুপ্রবেশ করে হ্যাকাররা। ধারণা করা হয়, একটি সাধারণ ফিশিং ইমেইলের মাধ্যমেই তারা এই অনুপ্রবেশের সুযোগ পায়। ওই ইমেইলে একটি ম্যালিশিয়াস লিঙ্ক বা ফাইল ছিল, যেটি ক্লিক করার পর ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়ে হ্যাকারদের ম্যালওয়্যার।
এই ম্যালওয়ারের মাধ্যমে তারা ব্যাংকের সুইফট (SWIFT) সিস্টেমে প্রবেশাধিকার লাভ করে। সুইফট হলো এক ধরনের আন্তর্জাতিক ফান্ড ট্রান্সফার সিস্টেম, যার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে টাকা আদান-প্রদান হয়ে থাকে।
$১ বিলিয়ন চুরির পরিকল্পনা!
হ্যাকারদের উদ্দেশ্য ছিল প্রায় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার (১ বিলিয়ন USD) চুরি করা। তারা নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে এই বিপুল অর্থ স্থানান্তরের নির্দেশ দেয়।
তারা সুইফট মেসেজের মাধ্যমে মোট ৩৫টি লেনদেনের অনুরোধ পাঠায়, যার মধ্যে বেশিরভাগ ছিল ফিলিপাইনের কিছু ব্যাংক এবং শ্রীলংকার একটি এনজিও-র নামে। সৌভাগ্যবশত, সুইফট মেসেজে কিছু বানান ভুল এবং সন্দেহজনক গন্তব্যের কারণে কিছু লেনদেন আটকে যায়।
$৮১ মিলিয়ন ডলার চলে যায় ফিলিপাইনে
তবে এর মধ্যেই হ্যাকাররা সফলভাবে ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকে পাঠিয়ে দেয়। এই অর্থের একটি বড় অংশ পরে স্থানান্তরিত হয় ক্যাসিনো খাতে, যেখানে নগদে উত্তোলন করে তা “মানি লন্ডারিং” করা হয়। অর্থাৎ, একবার যখন টাকা ক্যাসিনোর ভেতরে ঢুকে পড়ে, তখন তা ট্র্যাক করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।
কীভাবে ধরা পড়ে?
যখন ব্যাংকের কর্মকর্তারা ৩৫টি লেনদেনের মধ্যে কিছু সন্দেহজনক লেনদেন লক্ষ্য করেন এবং টাকা গন্তব্যে না পৌঁছানোর খবর আসে, তখন বিষয়টি সামনে আসে। পরে আন্তর্জাতিক তদন্তে উঠে আসে, এটি একটি সুপরিকল্পিত সাইবার হামলা, যাতে আধুনিক প্রযুক্তি, দীর্ঘদিন নজরদারি এবং ভুয়া পরিচয়ের বিস্তর ব্যবহার ছিল।
কে ছিল এর পেছনে?
বিশ্বের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার মতে, এই হামলার পেছনে উত্তর কোরিয়ার “Lazarus Group” নামের হ্যাকার দল জড়িত। তারা আগে থেকেই বিভিন্ন ব্যাংক, এটিএম নেটওয়ার্ক এবং ক্রিপ্টো এক্সচেঞ্জে হ্যাকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
কী শিখলাম আমরা?
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, আধুনিক যুগে শুধু ফিজিক্যাল নিরাপত্তা যথেষ্ট নয়। সবচেয়ে সুরক্ষিত ব্যাংকও একটি ফিশিং ইমেইলের কারণে ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এই ঘটনার পর পুরো বিশ্বে ব্যাংকিং সিস্টেমের সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে।
উপসংহার
বাংলাদেশ ব্যাংক হ্যাক কেলেঙ্কারি ছিল আধুনিক যুগের সবচেয়ে চমকে দেওয়া সাইবার অপরাধগুলোর একটি। এটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে, ডিজিটাল নিরাপত্তা কোনো বিলাসিতা নয়, এটি এখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অংশ। আর আমরা যারা অনলাইন ব্যবহার করি, তাদের প্রত্যেককেই হতে হবে আরও সতর্ক ও সচেতন।
Add comment