যেভাবে হত্যা করা হয়েছিল লাদেনকে: এক গোপন অভিযানের রোমাঞ্চকর কাহিনি
২০১১ সালের ২ মে, এক গভীর রাতে পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যায় একটি নাটকীয় ও চাঞ্চল্যকর অভিযান। যুক্তরাষ্ট্রের নেভি সিল (Navy SEAL) বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদ শহরে একটি গোপন আবাসে অভিযান চালিয়ে হত্যা করে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে আলোচিত চরিত্র—ওসামা বিন লাদেনকে। এই ঘটনাটি এতটাই গোপন ও নাটকীয় ছিল যে, এটি এখনও মানুষের মনে কৌতূহল জাগায়। চলুন জেনে নেই কীভাবে ঘটেছিল এই ঐতিহাসিক হত্যাকাণ্ড।
গোপন আস্তানা: অ্যাবোটাবাদে লাদেনের আশ্রয়
ওসামা বিন লাদেন ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন। এরপর থেকেই তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় ছিলেন। এক দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা সংস্থার চোখ এড়িয়ে লাদেন পালিয়ে বেড়িয়েছেন। কিন্তু অবশেষে ২০১০ সালের দিকে CIA গোয়েন্দারা জানতে পারে যে, পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে একটি তিনতলা ভবনে তার থাকার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই বাড়িটি ছিল অস্বাভাবিকভাবে সুরক্ষিত—উচ্চ প্রাচীর, কাঁটাতার, এবং খুব কম বাইরের যোগাযোগ। এমনকি বাড়ির বাসিন্দারা ফোন বা ইন্টারনেটও ব্যবহার করতেন না। এতে CIA-এর সন্দেহ আরও বাড়ে।
অভিযানের প্রস্তুতি
নেভি সিলের এলিট টিম SEAL Team 6, যাদের “ডেভগ্রু” নামেও ডাকা হয়, তাদের নির্বাচন করা হয় এই মিশনের জন্য। পুরো মিশনটি ছিল অত্যন্ত গোপনীয়, এমনকি পাকিস্তানকেও জানানো হয়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা সরাসরি এই অভিযানের তদারকি করেন।
প্রায় কয়েক মাসের গোয়েন্দা নজরদারির পর, ২০১১ সালের ২ মে ভোর রাতে দুইটি ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারে করে সিল টিম অ্যাবোটাবাদের উদ্দেশে যাত্রা করে। হেলিকপ্টার গুলো রাডার ফাঁকি দিয়ে বাড়ির কাছাকাছি নামিয়ে দেয় টিমকে।
ঘন অন্ধকারে অভিযান শুরু
রাত ১টার দিকে অভিযান শুরু হয়। প্রথম হেলিকপ্টারটি যান্ত্রিক সমস্যায় পড়ে বাড়ির ভেতরই ক্র্যাশ করে, কিন্তু কেউ হতাহত হয়নি। অন্য হেলিকপ্টার থেকে নামা টিম দ্রুত বাড়ির আশপাশ ঘিরে ফেলে এবং প্রবেশ করে।
প্রথমেই তারা বাড়ির দোতলা ও তৃতীয় তলার দিকে এগিয়ে যায়। প্রতিটি রুম খুঁজে খুঁজে তারা অবশেষে তৃতীয় তলায় একটি কক্ষে প্রবেশ করে, যেখানে ওসামা বিন লাদেন ছিলেন তার পরিবারের সঙ্গে।
চূড়ান্ত মুহূর্ত
নেভি সিল সদস্যরা তাকে আত্মসমর্পণের সুযোগ দেননি। ধারণা করা হয়, লাদেন নিজেও প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেননি। খুব দ্রুত তাকে মাথায় এবং বুকে গুলি করা হয়। ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন।
মৃতদেহ অপসারণ ও সাগরে দাফন
মিশন শেষে তার মৃতদেহ সংগ্রহ করে হেলিকপ্টারে করে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে নিশ্চিত হওয়া হয় যে এটি ওসামা বিন লাদেনের দেহ, ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্র পরে তার মরদেহ ইসলামী নিয়ম মেনে সমুদ্রে দাফন করে, যাতে তার কবর কোনো স্মারকস্থানে পরিণত না হয়।
বিশ্বে প্রতিক্রিয়া
এই অভিযানের খবর যখন প্রকাশিত হয়, বিশ্বজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। মার্কিন জনগণ রাস্তায় নেমে উল্লাস করে। আবার অনেকেই এই মিশনের গোপনীয়তা এবং পাকিস্তানের ভূমিকাকে ঘিরে প্রশ্ন তোলে।
উপসংহার
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু শুধুমাত্র একজন সন্ত্রাসীর সমাপ্তি ছিল না, বরং এটি ছিল এক যুগান্তকারী গোয়েন্দা এবং সামরিক অভিযানের সফলতা। তার হত্যাকাণ্ড বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দেয় যে, অন্যায় যতোই শক্তিশালী হোক না কেন, ন্যায় তার বিচার একদিন হবেই। এই ঘটনাটি প্রমাণ করে যে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম যত কঠিনই হোক, তা কখনো থেমে থাকে না।
Add comment