তাঁর চোখ ছিল মহাকাশের দিকে, হৃদয়ে ছিল স্বপ্নের জ্বলন্ত আগুন। ভারতের এক সাধারণ পরিবার থেকে উঠে এসে হয়ে উঠেছিলেন মহাকাশে যাওয়া প্রথম ভারতীয় নারী। তিনি কল্পনা চাওলা—একটি নাম, একটি অনুপ্রেরণা, একটি স্বপ্ন, যা লক্ষ কোটি হৃদয়ে আজও জ্বলজ্বল করে। কিন্তু সেই উজ্জ্বল নক্ষত্রটি একদিন হারিয়ে যায় অসীম মহাকাশের অতলে। চলুন জেনে নিই, কল্পনা চাওলার সেই শেষ যাত্রার হৃদয়বিদারক কাহিনি।
ছোট শহর থেকে মহাকাশের পথে
কল্পনা চাওলার জন্ম হয় ১৯৬২ সালের ১৭ মার্চ, ভারতের হরিয়ানার করনাল শহরে। ছোটবেলা থেকেই তার আগ্রহ ছিল আকাশের তারাদের প্রতি। প্লেন, মহাকাশযান—সবকিছুই তাকে টানত। পরিবারের বাধা, সমাজের চোখরাঙানি—সব উপেক্ষা করে তিনি পৌঁছে যান যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে তিনি অ্যারোনটিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে মাস্টার্স এবং পিএইচডি করেন।
১৯৯۷ সালে, তিনি প্রথমবারের মতো মহাকাশে পাড়ি জমান, নভোযান STS-87 মিশনের মাধ্যমে। তখনই তিনি বিশ্বের নজরে আসেন।
দ্বিতীয় মিশন—একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন
২০০৩ সালে কল্পনা দ্বিতীয়বারের মতো মহাকাশ যাত্রা করেন STS-107 কলম্বিয়া স্পেস শাটল-এর মাধ্যমে। এই মিশনে তার সঙ্গে ছিলেন আরও ছয়জন মহাকাশচারী। মিশনের উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক গবেষণা করা, বিশেষ করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল এবং জৈব রসায়ন নিয়ে।
১৬ দিনের সফল মিশন শেষে, সবাই অপেক্ষা করছিল মহাকাশযানটির পৃথিবীতে ফেরার। কিন্তু সেই প্রত্যাবর্তনই হয়ে ওঠে ইতিহাসের এক নির্মম ট্র্যাজেডি।
সেই ভয়াল দিন: ১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৩
২০০৩ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। কলম্বিয়া স্পেস শাটল যখন পৃথিবীতে ফিরে আসছিল, তখন তার বাম উইং-এ থাকা তাপ প্রতিরোধক প্যানেলটি (thermal protection system) উৎক্ষেপণের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল—যার ফলে পুনঃপ্রবেশকালে চরম তাপে পুরো শাটলটি ভেঙে পড়ে।
মাত্র ১৬ মিনিট আগেই পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করার কথা ছিল। কিন্তু সেই যাত্রা আর শেষ হলো না। টেক্সাসের আকাশে ছড়িয়ে পড়ে শাটলের ধ্বংসাবশেষ। পৃথিবীর বুকে থেমে যায় সাতজন মহাকাশচারীর প্রাণ।
পৃথিবীর মাটিতে না ফেরার গল্প
কল্পনা চাওলা আর ফেরেননি। কিন্তু তার স্বপ্ন, তার সংগ্রাম আর সাহস আজও অনুপ্রেরণা হয়ে বেঁচে আছে। সেই মেয়েটি, যে ছোটবেলায় পেপার প্লেন বানিয়ে আকাশে ওড়াত, সে একদিন সত্যিকারের মহাকাশে উড়েছিল। আর তার জীবনের শেষ অধ্যায় লিখে গেছে এক মহান আত্মত্যাগের কাব্য।
তাকে নিয়ে আজও বিশ্ব কাঁদে
তার মৃত্যু শুধু ভারতের নয়, গোটা বিশ্বের হৃদয়ে গভীর শোকের সৃষ্টি করেছিল। নাসা, ভারত সরকার, এবং বিভিন্ন দেশের মানুষ তাকে স্মরণ করে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে। ভারতের স্কুল, সড়ক, স্টেডিয়াম এমনকি একটি স্যাটেলাইটের নামকরণও করা হয়েছে তার নামে।
উপসংহার
কল্পনা চাওলা আজ নেই, কিন্তু তার স্বপ্ন আজও আছে। তার জীবন প্রমাণ করে—স্বপ্ন যদি সত্যি করতে চাও, তবে আকাশও সীমা নয়। সে ছিল এক নক্ষত্র, যা হয়তো চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেছে, কিন্তু আজও অনন্ত আকাশে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।
Add comment